আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র: বাংলাদেশের অবস্থান ও প্রভাব বিশ্লেষণ,,,

আত্তাহী

0 1,678

আত্তাহী

আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র: বাংলাদেশের অবস্থান ও প্রভাব বিশ্লেষণ,,,

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র (UNDRIP) গৃহীত করে। এটি অধিকার বঞ্চিত প্রকৃত আদিবাসী জাতিদের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষায় একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণ করে। ঘোষণাপত্রটি বিশ্বের আদিবাসীদের মর্যাদা, মঙ্গল এবং তাদের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য প্রণয়ন করা হয়। তবে, এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এবং এর প্রভাব নিয়ে নানা প্রশ্ন এবং বিতর্ক রয়েছে।

 

ঘোষণাপত্র বা UNDRIP-এর মূল প্রতিপাদ্য বা প্রধান উদ্দেশ্য হলো প্রকৃত আদিবাসীদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু অধিকার নিশ্চিত করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

ভূমির অধিকার: নিজ ভূমি ও সম্পদের ওপর একক নিয়ন্ত্রণ।

আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার: নিজস্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো রক্ষা।

স্বায়ত্তশাসন অধিকার: অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

জাতীয়তা অর্জনের অধিকার: স্বীকৃত রাষ্ট্রের অধীনে নাগরিকত্ব।

জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের অধিকার: রাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত অধিকার লঙ্ঘন বা বৈষম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ।

 

ঘোষণাপত্র স্বীকৃতির প্রভাব ও সম্ভাব্য ক্ষতি

 

জাতিসংঘের এই প্রস্তাবনা অনুসারে, রাষ্ট্রের ভেতরে কোনো বিশেষ জাতিগোষ্ঠীকে ভূমি ও স্বায়ত্তশাসনের মতো কিছু অধিকার প্রদান বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর অনেক দেশের সাংবিধানিক কাঠামোর জন্যই চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।UNDRIP-এর অধীনে ভূমি, সম্পদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার স্বীকার করা হলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও ঐক্যে প্রভাব পড়তে পারে। এসব অধিকারের মাধ্যমে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টাকে উসকে দেওয়া যেতে পারে।

যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের মধ্যে “আদিবাসী” স্বীকৃতি দাবি জোরালো হচ্ছে। এটি একদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বাড়াতে পারে, অন্যদিকে বিদেশি শক্তিগুলোকে পরিস্থিতি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার সুযোগ তৈরী করে দিতে পারে।

জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠী সম্পর্কিত ঘোষণায় এমন কিছু ধারা রয়েছে যা একটি রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্নতাবাদ সহ কূটনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

 

বাংলাদেশের অবস্থান

 

সরকারি নীতিমালায় দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জন্য পর্যাপ্ত অধিকার স্বীকৃত থাকলেও, যথাযথ কারনে তাদের “আদিবাসী” হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বিধায় বর্ণিত জাতিসংঙ্ঘের প্রস্তাবনাটি স্বভাবতই এদেশের জন্য এক কথায় অপ্রযোজ্য।

 

আদিবাসী বনাম উপজাতি প্রসঙ্গ

 

বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে একটি সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে যে, দেশে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা উপজাতিদের প্রকৃত অর্থে আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। এই অবস্থানের পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক কিছু কারণ।

আদিবাসী শব্দটি সাধারণত এমন জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যারা একটি ভূখণ্ডে প্রাচীনতম বা স্থিত দখলদার জাতির পূর্ব হতে বসবাস করে আসছে এবং যারা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিচয় সংরক্ষণ করে চলেছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ সংস্থা যেমন ILO এবং UNDRIP-এর সংজ্ঞায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের ভূখণ্ডের সাথে প্রাচীন সম্পর্ক, ঐতিহ্য, ভাষা এবং সংস্কৃতি ধরে রাখার উপর ভিত্তি করে চিহ্নিত হয়। সেই আঙ্গিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীরা মূলত এই অঞ্চলে অভিবাসী। তারা বিগত ২-৩ শতক হতে ভারত, চিন, মায়ানমার সহ বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে চট্টগ্রামে এসে অবস্থান গ্রহণ করেছে যা সর্বজন স্বীকৃত। অন্যদিকে বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাঙালিদের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস ৫০০০ বছরেরও বেশী পুরোনো। যুগে যুগে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মূল জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি সতন্ত্র জীবনধারা সম্বলিত এরূপ যাযাবর জাতিগোষ্ঠী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা বসবাস করে আসছে। তারা মূলত একটি দেশের মূল জাতিকে বৈচিত্র মন্ডিত করে তবে কোনো ভাবেই তারা নিজেদের সেই দেশের আদিবাসী হিসেবে দাবি করতে পারে না। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তারা স্বভাবতই আর সব নাগরিকদের মতো সম অধিকার ভোগ করে থাকে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ সুবিধাও পেয়ে থাকে যা এদেশেও বিদ্যমান। সম্প্রতি জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্র কে ঘিরে এদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাধারণ জনগণকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সায়ত্বশাসন ও ভূমির ওপর একক আধিপত্যের লোভ দেখিয়ে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির পায়তারা করছে একটি স্বার্থান্বেষী কুচক্রিমহল । আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে

বাংলাদেশ সরকার সাংবিধানিক ভাবে “উপজাতি” শব্দ ব্যবহারের নির্দেশনা জারি করলেও অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও এবং মিডিয়া “আদিবাসী” শব্দটি প্রচারে উৎসাহী। তাই প্রসঙ্গতই দেশের অনেকেই মনে করে, খ্রিস্টান মিশনারি, পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠী এবং বিদেশি শক্তিগুলোর আর্থিক সহায়তায় এই সংক্রান্ত কোনো একটি বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

 

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রকৃত ইতিহাস

 

বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী যেমন চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতাল, ত্রিপুরা ইত্যাদি তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। তবে তারা এই ভূখণ্ডের প্রাচীনতম অধিবাসী নয়। বাংলাদেশের প্রধান জাতিগোষ্ঠী বাঙালিদের মতো এদেরও আগমন ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। ইতিহাস বলে, এই জনগোষ্ঠীগুলোর একটি বড় অংশ পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অভিবাসন বা স্থানান্তরের মাধ্যমে এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। উল্লেখ্য ২০০৭ সালে জাতিসংঙ্ঘের আদিবাসী প্রস্তাবনা উত্থাপনের পূর্বে এই নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত ছিল না। এমনকি উপজাতিও লোকগাঁথা, ধর্ম গ্রন্থ এমনকি তাদের স্বজাতীয় গবেষকরাও এব্যাপারে একই মোত পোষণ করেছেন এমনকি গবেষণা ও সাহিত্য গ্রন্থও রচনা করেছেন। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই এগুলো অস্বীকার করার পায়তারা করছে।

 

“আদিবাসী” স্বীকৃতির প্রভাব ও ক্ষতিকর দিক

 

১. ঐতিহাসিক প্রভাব : বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসরত উপজাতি জনগোষ্ঠীগুলো প্রাচীন ঐতিহাসিক দলিল ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুযায়ী, এ অঞ্চলের প্রাচীনতম বাসিন্দা নয়। আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করলে এটি একটি মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর ধারণা সৃষ্টি করতে পারে।

২. ভৌগোলিক সংযোগ: উপজাতি জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্য পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন মিয়ানমার, ভারত এবং নেপালের সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তাদের ভাষা, ধর্ম এবং ঐতিহ্যগত প্রভাব এই সম্পর্কের প্রমাণ বহন করে।

৩. রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব: বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক “আদিবাসী” শব্দের ব্যবহার পরিহার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো এটি আন্তর্জাতিকভাবে ভূখণ্ডগত দাবি উত্থাপন বা আঞ্চলিক বিভাজনের আশঙ্কা সৃষ্টি করতে পারে।

৪. জাতীয় সংহতি রক্ষা: বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক, বহু-সংস্কৃতির দেশ। তবে, সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র সব নাগরিককে সমান অধিকার নিশ্চিত করে। উপজাতি জনগোষ্ঠীর জন্য ইতিমধ্যেই বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে যেমন সংরক্ষিত আসন, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সহায়তা। “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহার করলে এটি বৃহত্তর জাতীয় সংহতির জন্য প্রতিবন্ধক হতে পারে।

 

বাংলাদেশের সংবিধান ও আদিবাসী প্রসঙ্গ

 

বাংলাদেশের সংবিধানে “আদিবাসী” শব্দটি উল্লেখ নেই। সংবিধানে এই জনগোষ্ঠীগুলোকে “ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের জন্য বিশেষ অধিকারেরও নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।

 

মিডিয়া ও জনমত

 

বাংলাদেশের কতিপয় গণমাধ্যম ও একই সাথে বিনোদন মাধ্যম “আদিবাসী” শব্দ প্রচারে বিশেষভাবে তৎপর, যা একটি বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। মূল প্রতিপাদ্যটি কৌশলে গোপন করে ‘উপজাতি’ শব্দের পরিবর্তে “আদিবাসী” শব্দের ব্যবহারে আজকাল অনেককেই বেশি আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। এর ফলে দেশের জনগণও অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে আদিবাসী শব্দ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।

মিডিয়ার এই আচরণ দেশীয় ঐক্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থায় কেবল প্রজ্ঞাপন জারি করে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। মিডিয়ার দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রচারণা বন্ধে রাষ্ট্রীয় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। একই সাথে এর আইনগত বিষয়টিও সামনে আনা উচিত।

 

রাষ্ট্রের করণীয়

 

গণমাধ্যমের মাধ্যমে “আদিবাসী” শব্দ প্রচার রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ।

সঠিক তথ্য প্রচারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নিজস্ব অবস্থান তুলে ধরা।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি প্রণয়ন।

 

সারবাক্য

UNDRIP আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হলেও, এটি নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক চাপে নতুন সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সরকারের উচিত নীতিনির্ধারণে সতর্ক থাকা এবং দেশের সার্বভৌমত্ ও একতা বজায় রাখতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

লেখকঃ

সহযোগী অধ্যাপক

লেখক, গবেষক,  পার্বত্য চট্টগ্রাম

Leave A Reply

Your email address will not be published.